শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৭:০৫ পূর্বাহ্ন

মার্ক-সাকারবার্গ গ্রেপ্তার: অসংখ্য তরুণীর অন্তরঙ্গ ছবি-ভিডিও ‘পমপম’ গ্রুপে

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ২২ মে, ২০২৩
  • ১৩

নিউজটি শেয়ার করুন

দীর্ঘদিন ধরে অসংখ্য কিশোরী-তরুণীর অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি-ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস করার ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইলসহ অর্থ দাবি করতো ‘পমপম’ নামে একটি আন্তর্জাতিক টেলিগ্রাম গ্রুপ । এছাড়া এসব ছবি-ভিডিও বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। চক্রের মূলহোতা মার্ক সাকারবার্গ ওরফে আবু সায়েমসহ ৯ জনকে গ্রেপ্তারের পর পুুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এমনটিই জানিয়েছেন। আজ সোমবার দুপুরে রাজধানীর মালিবাগ সিআইডি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া এসব তথ্য জানান।

গ্রেপ্তাররা হলো- গ্রুপের মূলহোতা মার্ক-সাকারবার্গ ওরফে আবু সায়েম, শাহরিয়ার আফসান অভ্র, বোগদাদী শাকিল, ডিটিআর শুভ ওরফে মশিউর রহমান, মো. জসীম, ক্যাকটাস ওরফে কেতন চাকমা, এল ডোরাডো ওরফে শাহেদ, তুর্য ওরফে মারুফ ও মিঞা ভাই ওরফে নাজমুল সম্রাট। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১১ টি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়েছে।

অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, তাদের ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম আইডি হ্যাক করে ‘পমপম’ নামের টেলিগ্রাম গ্র“পে তাদের গোপন ছবি ও ভিডিও নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ দাবি করতো। অর্থ দিতে না পারলে ভিডিওকলে এসে আপত্তিকর দৃশ্য করতে বাধ্য করতো। আর কোনো প্রস্তাবেই সাড়া না দিলে ভুক্তভোগীদের নাম-পরিচয় ও ব্যক্তিগত তথ্যসহ লাখ লাখ সাবস্ক্রাইবারের টেলিগ্রাম গ্র“পগুলোতে ভাইরাল করে দিতো চক্রটি।

সিআইডি প্রধান বলেন, কিশোরী-তরুণীরা অভিভাবকদের রাত জেগে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজের কথা বলতো। অভিভাবকরা নিশ্চিতে থাকতেন তাদের সন্তান ফ্রিল্যান্সিং করছেন। কিন্তু ফ্রিল্যান্সিংয়ের আড়ালে তারা অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি-ভিডিও দিতে বাধ্য হতেন। এছাড়া আপত্তিকর ভিডিও ভাইরালের ভয় দেখিয়ে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের পাশাপাশি চক্রটি ওইসব ভিডিও দেশে-বিদেশে বিক্রি করেও কোটি কোটি টাকা আয় করেছে। মাসে এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকা সাবস্ক্রিপশন ফি দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, পর্তুগাল, কানাডা, আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডের মতো দেশের অসংখ্য ক্রেতা পমপম গ্র“পটির সদস্য হয়েছেন। তারা অল্পবয়সী তরুণীদের আপত্তিকর ওইসব কন্টেন্ট কিনে সংরক্ষণ করেন।

সিআইডি জানায়, চক্রটির নেতৃত্ব দেয় মার্ক-সাকারবার্গ ওরফে আবু সায়েম চট্টগ্রামে থাকেন। এনআইডি অনুযায়ী, তার বয়স ২০ বছর। তিনি শ্যামলী পলিটেনিক ইনস্টিটিউট ও চট্টগ্রাম থেকে ইলেকট্রিক্যালে ডিপ্লোমা করেছেন। তার বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।

সিআইডি প্রধান বলেন, এরই মধ্যে আরাফাত নামের এক ভুক্তভোগী তার এবং তার প্রেমিকার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি পমপম গ্র“পে ছড়িয়ে দেওয়ায় রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় মার্ক-সাকারবার্গ ও তার দলের বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা করেন। পরে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় চট্টগ্রামের লালখান বাজারে অভিযান চালিয়ে মূলহোতা মার্ক ওরফে সায়েমকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার তথ্যে, তার ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু শাহরিয়ার আফসান অভ্রকে চট্টগ্রামের হাউজিং এলাকা থেকে এবং বোগদাদী শাকিলকে উখিয়া থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এক পর্যায়ে মোবাইল ফোন তল্লাশি করে মার্ক-সাকারবার্গ আইডিটি লগইন করা অবস্থায় পাওয়া যায়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে পমপম গ্র“পের যতগুলো চ্যানেল এবং গ্রুপ আছে তার অ্যাডমিনদের আসল নাম-পরিচয় পাওয়া যায়। অ্যাডমিনদের কাজ ছিল মার্কের হয়ে নতুন নতুন কনটেন্ট জোগাড় করা। নতুন কনটেন্ট পেতে তারা ফেক এনআইডি বানিয়ে টার্গেটের ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রাম আইডি হ্যাক করতেন একসময়।

পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ভুক্তভোগী তরুণীদের সাবেক প্রেমিকরাই প্রেমিকার সঙ্গে কাটানো অন্তরঙ্গ মুহূর্তে নতুন নতুন কনটেন্ট দিতেন ওই গ্রুপে। অথ্যাৎ, সুসময়ে প্রেমিকার যেসব অন্তরঙ্গ মুহুর্ত তারা ক্যামেরাবন্দী করেছে, সেগুলোই প্রতিশোধের নেশায় তুলে দেয় মার্ক-সাকারবার্গদের গ্রুপে।

মার্ক তার অ্যাডমিনদের দিয়ে সেসবে মিউজিক বসিয়ে ফেসবুক আইডি থেকে ছবি নিয়ে ৩০-৪০ সেকেন্ডের প্রমো বানিয়ে আপলোড করতেন গ্র“পগুলোতে। প্রমো দেখে যারা ফুল ভার্সন দেখতে চাইতেন তাদের এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকায় প্রিমিয়াম সার্ভিস কিনতে হতো। মার্ক ওরফে সায়েম, অভ্র ও শাকিলকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং তাদের ডিভাইস তল্লাশি করে মার্ক-সাকারবার্গের বিভিন্ন পেজের অ্যাডমিনদের আসল পরিচয় উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার মশিউরের দায়িত্ব ছিল গ্রুপ থেকে কৌশলে কনটেন্ট সংরক্ষণ করে রাখা এবং নানা প্রলোভনে তরুণীদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও হাতিয়ে নেওয়া। তাকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থেকে ও সহযোগী জসীমসহ গ্রেপ্তার করা হয়।

সায়েম ও মশিউরকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে সিআইডি প্রধান বলেন, এসব গ্র“পে যুক্ত অ্যাডমিনদের অনেকেই ঢাকায় অবস্থান করছেন। ফলে তাদের বেইলি রোড এলাকার একটি রেস্টুরেন্টে গেটটুগেদারের ফাঁদ পাতা হয়। ফাঁদে পা দেওয়ায় একে একে গ্রেপ্তার করা হয়। অ্যাডমিন ক্যাকটাস ওরফে কেতন চাকমা, এল ডোরাডো ওরফে শাহেদ, তুর্য ওরফে মারুফ এবং মিঞা ভাই ওরফে নাজমুল সম্রাটকে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। মার্ক-সাকারবার্গ এবং তার সহযোগীদের গ্রুপ ও চ্যানেলগুলোয় সাবস্ক্রাইবের সংখ্যা প্রায় সোয়া চার লাখ। সেগুলোতে ২০ হাজার আপত্তিকর ভিডিও এবং প্রায় ৩০ হাজার কনটেন্ট রয়েছে। অন্যদিকে মাসে এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকা ফি দিয়ে তাদের প্রিমিয়াম গ্র“পের সদস্য হয়েছেন দেশ-বিদেশের প্রায় সাড়ে ৭’শ মানুষ। তাদের বিস্তারিত নিয়ে কাজ করছে সিআইডি। তরুণীদের এডাল্ট কন্টেন্ট কেনা-বেচার সঙ্গে জড়িত কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।

মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, আমরা জেনেছি ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর অনেকে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। বোনের ভিডিও সরিয়ে নিতে ভাইয়ের কান্নাও আমাদের চোখে পড়েছে। ভূক্তভোগি কিশোরীদের অনেকেই এই অসহায়ত্বের কথা কাউকেই বলতে না পেরে ক্রমেই মানসিক অবসাদে আক্রান্ত হয়েছে।

সবাইকে সচেতন করে সিআইডি প্রধান বলেন, এ ঘটনায় ভুক্তভোগী তরুণীদের সঙ্গে কথা বলে আমাদের মনে হয়েছে, একান্ত মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি এবং তা আদান-প্রদান করে তারা যেমন ভুল করেছেন, তেমনিভাবে সেই ভুল করে বিপদে পড়া কঠিন সময়ে তারা নির্ভরযোগ্য কাউকে পাশে পায়নি, না পরিবার, না অন্যান্য স্বজন। ফলে অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায়তারা কোনো আইনের আশ্রয় নিতে পারেনি।

 

এ জাতীয় আরো খবর..

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত আজকের অর্থনীতি ২০১৯।

কারিগরি সহযোগিতায়:
x