বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:২২ অপরাহ্ন

বাজেটে তামাক কর প্রস্তাব: তামাক কোম্পানির লাভ বাড়বে, সরকার ও জনস্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ৯ জুন, ২০২২

নিউজটি শেয়ার করুন

২০২২-২৩ অর্থ-বছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের কর কাঠামো তামাক ব্যবহার কমাতে কোনো ধরনের ভূমিকা রাখবে না। বরং এ কর ব্যবস্থা তামাক কোম্পানিকে নতুন ধূমপায়ী সৃষ্টি এবং পুরনো ধূমপায়ীকে উৎসাহী করতে সহযোগিতা করবে; সুনির্দিষ্ট কর আরোপ না করে মূল্যের ওপর শতাংশ হারে করারোপ পদ্ধতি অব্যাহত রাখায় কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ থেকে যাবে এবং এতে অনাকাংখিতভাবে তামাক কোম্পানী বিপুল পরিমাণ অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করবে। আজ জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেসনে মাননীয় অর্থমন্ত্রী ঘোষিত বাজেট প্রস্তাবে তামাকজাত দ্রব্যের মূল ও কর প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়ায় একথা জানায় তামাক নিয়ন্ত্রণে কার্যরত সংগঠন বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট (বাটা) ও বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক ফর টোব্যাকো ট্যাক্স পলিসি (বিএনটিটিপি)।

তামাকজাত দ্রব্যের ওপর প্রস্তাবিত মূল্য ও কর প্রস্তাব হতাশাজনক উল্লেখ করে তারা বলেন, বাংলাদেশে প্রায় ৭২ ভাগ মানুষ নিম্নস্তরের সিগারেট সেবন করে। অথচ এই স্তরের করহার না বাড়িয়ে নামমাত্র মূল্য বৃদ্ধিতে দেশে ধূমপানের পরিমাণ বাড়বে এবং মানুষের ক্রয় স্বামর্থ বৃদ্ধি এবং মূল্য স্ফীতির তুলনায় সিগারেট সহজলভ্য হওয়ায় কিশোর-তরুণরা ধূমপান শুরু করতে উৎসাহিত হবে। একইসাথে জর্দা, গুল ও বিড়ির মূল্য পূর্বাবস্থায় বহাল থাকায় এগুলোর ব্যবহারকারীর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্বক হুমকি বয়ে আনবে, তামাক ব্যবহারজনিত অসুস্থ্যতা ও মৃত্যু মারাত্বক আকার ধারণ করবে। একইসাথে সুনির্দিষ্ট করারোপ পদ্ধতির প্রবর্তন না করায় সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাবে। বিপরীতে তামাক কোম্পানি ধারাবাহিকভাবে লাভবান হবার পাশাপাশি তাদের মুনাফা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে।

তামাক বিরোধী সংগঠনসমূহের মতে, জর্দা, গুল ও বিড়ির মূল্য বহাল রাখা এবং নিম্ন স্তরের সিগারেটের মূল্য আশানুরূপ বৃদ্ধি না করায় বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যঝুঁকি ভয়াবহভাবে বেড়ে যাবে। একইসঙ্গে তাদের তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হারও বাড়বে। তামাক ব্যবহারজনিত রোগ ও মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার ফলে দেশ বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়বে।

তারা আরো বলেন, দেশে সিগারেটের অধিকাংশই বিক্রি হয় খুচরা শলাকা হিসাবে। সিগারেটের ১০ শলাকার মূল্য প্রিমিয়াম স্তরে ৭ টাকা, উচ্চস্তরে ৯ টাকা, মধ্যম স্তরে মাত্র ২ টাকা এবং নিম্নস্তরে মাত্র ১ টাকা বৃদ্ধিতে খুচরা শলাকার দামে তেমন কোন পরিবর্তন আসবে না। এতে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া নিম্নস্তরের প্রতি শলাকার দাম বাড়বে মাত্র ১০ পয়সা বা ২.৫৬% এবং মধ্যমস্তরে ২০ পয়সা বা মাত্র ৩.১৭%। উচ্চ ও প্রিমিয়াম স্তরের ভোক্তারা অবস্থাপন্ন শ্রেণীর হওয়ায় এই স্তরে সামান্য মূল্য বৃদ্ধি ব্যবহার কমাতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে না। যেখানে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে গত এক বছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় প্রায় ৯% বৃদ্ধি পেয়েছে, সেই তুলনায় সিগারেটের সামান্য মূল্য বৃদ্ধি এবং জর্দা, গুল ও বিড়ির মূল্য বহাল রাখা তামাকজাত দব্যকে আরো সস্তা করেছে। এর ফল স্বরূপ তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনের লক্ষ্যও বাধাগ্রস্ত হবে।

প্রতিক্রিয়ায় তারা আরও যোগ করেন, সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের চেয়ে বেশি দামে সিগারেট বিক্রির কারণে সরকার চলতি অর্থবছরে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব হারিয়েছে। প্রায় প্রতিবছরই তামাক কোম্পানি বাজেটের আগে কারসাজি করে সিগারেটের মূল্য বৃদ্ধি করে কোটি কোটি টাকা  রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে এবং বিপুল পরিমাণ অযাচিত মুনাফা অর্জন করছে। এই বছরও বাজেট ঘোষণার আগেই তামাক কোস্পানীগুলো গত ১৭ মে থেকে ৯ জুন পর্যন্ত মূল্য-কারসাজির মাধ্যমে অতিরিক্ত মূল্যে সিগারেট বিক্রি করেছে। এই মুল্য বাজেটের প্রস্তাবিত মূল্যের চেয়ে স্তরভেদে ১৫ টাকা থেকে ৩১ টাকা বেশি। এর মাধমে তামাক কোম্পানীগুলো দৈনিক প্রায় ২০ কোটি হারে গত ২৪ দিনে অবৈধভাবে প্রায় ৪৮০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতায় সহজেই অনুমান করা যায়, আগামী অর্থ-বছরে তারা এই বর্ধিত মূল্য অব্যহত রাখবে। বিগত বছরগুলোর ন্যায় বাজেটে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত মূল্যে সিগারেট বিক্রির এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে আগামী অর্থবছরেও তামাক কোম্পানিগুলো অবৈধভাবে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা অরতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করবে এবং সরকার কমপক্ষে ৫,৬০০ কোটি টাকা রাজস্ব হারাবে। এসব বন্ধে দেশের তামাক বিরোধী সংগঠনগুলো তামাকজাত দ্রব্যের ওপর সুনির্দিষ্ট করারোপের দাবীসহ মূল্য ও কর বিষয়ে সরকারের কাছে যে প্রস্তাব পেশ করেছে তার কোনো প্রতিফলনই এই বাজেটে নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বিএনটিটিপি এর কনভেনর ড. রুমানা হক বলেন, বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতিও প্রায় ৫.৬% হারে বেড়েছে। ফলে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যও প্রতিনিয়ত বাড়ছে কিন্তু সেই বিবেচনায় তমাকজাত দ্রব্যের দাম আশানুরূপ না বাড়ানোয় তা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে আরো সহজলভ্য হয়েছে।

তামাক নিয়ন্ত্রণে কর্মরত সংস্থাগুলো এবছরের বাজেটে তামাকজাত দ্রব্যের জন্য যে মুল্য, কর এবং সুনির্দিষ্ট করারোপ পদ্ধতি প্রবর্তনের প্রস্তাব করেছিল সেটি বাস্তবায়িত না হওয়ায় তামাক কোম্পানীগুলো নিম্নস্তরের সিগারেটে প্রায় ৭০৫ কোটি, মধ্যস্তরে প্রায় ১১৪.৫ কোটি, উচ্চস্তরে প্রায় ৯৭ কোটি এবং প্রিমিয়াম স্তরে প্রায় ৯০ কোটি টাকা বেশি মুনাফা করবে। এর সাথে অতিরিক্ত মূল্যে বিক্রির কারণে অর্জিত মুনাফা যুক্ত হয়ে তা প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকায় হবে। একটি বহুজাতিক তামাক কোম্পানির নিজস্ব হিসাব দেখা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মাত্র ১০ বছরে তাদের উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণ কিন্তু একই সময়ে তাদের মুনাফা বেড়েছে পাঁচ গুণ। আমাদের ত্রুটিপূর্ণ কর ব্যবস্থার কারণেই এটি হচ্ছে।

২০২০ সালে দেশে ১ লাখ ৬২ হাজার মানুষ তামাকজনিত রোগে মৃত্যুবরণ করেছে। এবারের বাজেটে তামাকজাত দ্রব্যের আশানুরূপ মূল্য বৃদ্ধি না হওয়ায় চলতি অর্থবছরে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়বে। তাই জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা ও রাজস্ব আয় বৃদ্ধি বিবেচনায় মাননীয় অর্থমন্ত্রীর এই প্রস্তাব পরিবর্তন করে মহান জাতীয় সংসদে আমাদের প্রস্তাব অনুসারে সুনির্দিষ্ট করারোপ পদ্ধতির প্রবর্তন ও সকল তামাকজাত দ্রব্যের ওপর যৌক্তিক পরিমানে মূল্য ও কর নির্ধারণ করা হবে বলে তিনি প্রত্যাশা করেন।

এ জাতীয় আরো খবর..

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত আজকের অর্থনীতি ২০১৯।

কারিগরি সহযোগিতায়:
x